২০২৪
11 বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশে আবারও রামপালবিরোধী জনমত গড়ে তুলছেন পরিবেশবাদীরা। শুরু থেকেই যান্ত্রিক ত্রুটি ও কয়লার সংকটে বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। এখন এর সঙ্গে অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। যদিও রামপালের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করছে বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল)। দেশের পরিবেশবাদীদের আন্দোলন অগ্রাহ্য করে সাবেক সরকার সুন্দরবনের খুব কাছে ভারতীয় বিনিয়োগে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করে।
শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ২০১০ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারত সফরে যান। ওই সময়ে কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রফতানি এবং একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
ভারতের রাষ্ট্রীয় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি (এনটিপিসি) বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। এর ভিত্তিতে রামপালে কেন্দ্র নির্মাণের জায়গা দেয় পিডিবি। ভারতের এক্সিম ব্যাংক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য দেড় বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থঋণ সহায়তা দেয়।
ভারতীয় ঋণে কেন্দ্রটি নির্মিত হওয়ায় দেশটির ‘হেব্বি ইলেক্টিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড’ কেন্দ্রটির ঠিকাদারি কাজ পায়। প্রথা অনুযায়ী যে দেশ ঋণ সহায়তা দেয় সেই দেশের কোনও কোম্পানিই নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে আবারও রামপালবিরোধী জনমত চাঙা হচ্ছে। তিরন্দাজ রেপার্টরি নামে একটি উদ্যোগে ‘বাগবিতণ্ডা’ শিরোনামে থিয়েট্রিক্যাল বাহাসের আয়োজনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবি জানান অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মাদ। তিনি অভিযোগ করেন, ভারতের জন্য সুন্দরবন ধ্বংস করে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি রামপালে দূষিত পানি ফেলার অভিযোগ তুলেছে। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)-এর ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের তথ্য থেকে জানা যায়, মাইদারা ও পশুর নদের পানি দূষিত হচ্ছে।
পিডিবি বলছে, গত বছর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সক্ষমতার মাত্র ২৪ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। গত বছর এপ্রিল, মে ও জুনে কয়লার অভাবে কেন্দ্রটি কয়েক দফা বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রটির মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। নিজস্ব ব্যবহার বাদ দিয়ে কেন্দ্রটি গ্রিডে ১ হাজার ২৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু কারিগরি ত্রুটি থাকায় কেন্দ্রটি বারবার বন্ধ হওয়ারও অভিযোগ ওঠে।
এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজয় প্রকাশকে হোয়াটসঅ্যাপ করা হলে বিআইএফপিসিএল-এর জনসংযোগ শাখা থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, তারা অপরিশোধিত কোনও বর্জ্য নদীতে ফেলছে না।
কেন্দ্রটিতে কয়লা সরবরাহ করছে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠান। কয়লা সরবরাহে কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এতে এখনও তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না। প্রায় মাস দুয়েকের কয়লার মজুত আছে। আরও দুটি কয়লাবাহী জাহাজ বহির্নোঙরে অবস্থান করছে। সুতরাং আগামী কয়েক মাসে কয়লার কোনও সমস্যা হবে না বলে তারা জানিয়েছে। এদিকে বিদ্যুতের চাহিদা না থাকায় আপাতত একটি ইউনিট চালু রাখা হয়েছে। সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রামপাল থেকে সর্বনিম্ন ৩৮০ মেগাওয়াট এবং সর্বোচ্চ ৬৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে।
তবে দেশে রামপালবিরোধী জনমত সৃষ্টির বিষয়ে বিআইএফপিসিএল থেকে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়কারী শরীফ জামিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের টেন্ডার ডকুমেন্ট বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা করে অনেক আগেই আমরা বলেছি যে এই প্রকল্প পশুর নদী ও সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি করবে। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর দূষণের আংশিক চিত্র সিইজিআইএস’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে। হাজার হাজার জেলে পরিবার মাছশূন্য পশুর পাড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। দেশ ও জাতির স্বার্থে অবিলম্বে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করে অধিকৃত জায়গায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের ব্যবস্থা করা উচিত।’
প্রসঙ্গত, গত ২৯ নভেম্বর বিকালে মোংলার কানাইনগর গির্জা মাঠে পশুর নদী ও সুন্দরবন সুরক্ষা এবং জলবায়ু ন্যায্যতার দাবিতে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), সুন্দরবন রক্ষায় আমরা, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ ও পশুর রিভার ওয়াটারকিপার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবিতে জনসমাবেশ করে। এতে বলা হয়, বাগেরহাটের রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ক্ষতি ও মরুকরণ তৈরি করছে। সুন্দরবনের প্রাণ পশুর নদীর দূষণে জলজ প্রাণী মারা যাচ্ছে। পশুর নদীতে বিষাক্ত পারদের মাত্রা এখন অনুমোদিত মাত্রার দশ গুণ বেশি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য বড় হুমকি। তাই এটি বন্ধ করতে হবে।